পেন্সিলে লেখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৪ নভেম্বর, ২০১৪, ০১:০২:১৭ রাত
এক.
২০০১ সাল।
রামপুরা টিভি সেন্টারের পিছনে বনশ্রী প্রোজেক্টের এক ভাড়া বাসায় আমরা থাকি। বল্লভপুর কলেজের চাকুরিটা সবে মাত্র ছেড়ে অন্য একটা জব খুজছি। আমার বড় কন্যা দেড় বছরের। আব্বা-আম্মা আর ভাইদের সাথে সময় ভালো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে ভালো যাচ্ছে না। আমি বেকার! আমার বউ এর মন খারাপ। কিন্তু সবাই কেমন এক মুখোশের আড়ালে ভালো থাকার অভিনয় করে চলেছি।
আর্মি এডুকেশন কোরের এক সার্কুলার দেখে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। এডমিট কার্ড এলো। নির্দিষ্ট দিনে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজে গিয়ে লিখিত পরীক্ষা ও দিয়ে এলাম। রেজাল্ট এর অপেক্ষা করছি। এর ভিতরে বিএনপি সরকার গঠন করেছে। খালেদা জিয়া এসে এক সার্কুলার দিয়ে সকল নিয়োগ পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেন।
মনটা ই খারাপ হয়ে গেল। এর আগে ১৯৯১ এ একবার আইএসএসবি তে গিয়ে ফেরত এসেছি।এবার খুব ভালো পরীক্ষা দেবার পরে ও...
ধুর শালায়!
আর কোনো জব ই করবো না।
আম্মা জিজ্ঞেস করলে বলিঃ 'ধান্দাবাজি করবো। টিভিতে দেখেন না, টাউট-বাটপার দেখায়, ও রকম একজন হয়ে যাবো।'
আমার মেজো ভাই এর সাথে মটরবাইকে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াই। নজরুলের মাজার, ছবিরহাট কিংবা চন্দ্রিমা উদ্যান- এসব যায়গায় একেকদিন বসি। নজরুল এর মাজার এর অবস্থা তখন এখনকার মতো ছিলো না। মসজিদের পাশের এই মাজার এর আশে পাশে ফেন্সীখোর / গাজাখোর / হেরোইনখোরদের প্রকাশ্যে আড্ডা ও নেশা করা কোনো ব্যাপারই ছিলো না। আর মাজারের সাথে দেয়ালের পাশে নেশাখোরেরা মূত্রত্যাগ করে ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ার ঘ্রানে বাতাসকে ও ঝাঁঝালো করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই গন্ধ আমাদের দক্ষ প্রশাসনের নাকে লাগত না।
আমার এই রকম অলস সময়ে আমার মনে নতুন কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে।একদিন প্রগতি প্রকাশনের একটা বই পেলাম। ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করলাম। কম্যুনিস্ট আন্দোলনের উপর লেখা।অবশ্য পলিটিক্যাল সাইন্স এর স্টুডেন্ট হিসাবে এ গুলো আমার আগেই পড়া। তবে তখন তা ছিলো একটা সার্টিফিকেট পাবার জন্য বাধ্যতামুলক পড়া। যাতে কোনো মজাই পেতাম না আমি।কিন্তু এবারের পড়াটা ছিলো নিজের মনের আনন্দে।
এর পর প্রতিদিন ই পুরানা পল্টনের ফুটপাতের বইগুলোর থেকে বেছে বেছে প্রগতি প্রকাশনের ছোট সাইজের বই দিয়ে আমার শোবার ঘরের বইয়ের তাক ভরে ফেলতে লাগলাম। সেই সাথে অনেক রাত জেগে পড়া। মেজো ভাই ছাড়া পরিবারের আর সবার সাথে আমার বরাদ্দকৃত সময়ের পরিমাণ কমে গেলো।
বই পড়ে নিজেকে অনেক বড় একজন কমরেড মনে হতে লাগল।
একদিন ফুটপাথের পরিচিত বইয়ের দোকানে গিয়েছি। দোকানদার আমাকে বেশ চিনে নিয়েছে। অনেক বই-ই তো তার কাছ থেকে কিনেছি। সেদিন অবশ্য মাসুদ রানার পুরনো কিছু বই খুঁজছিলাম। বইয়ের এলোমেলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রাশির ভিতর থেকে হঠাৎ তামাটে রঙের বাঁধানো একটি বইয়ের দিকে নজর পড়ল। দোকানদারকে ওটা দিতে বললাম। সে আমার হাতে দিলে পাতা উল্টিয়ে বেশ অবাক হলাম। একটা ডায়েরি।
ডায়েরি।
তবে বেশ পুরনো। প্রথম পাতাগুলোতে বল পয়েন্ট কলম দিয়ে মেয়েলী হাতে লিখা।
কিভাবে বুঝলাম মেয়েলী হাতের লিখা?
লিখা দেখেই। সুন্দর কাটা কাটা লিখা... কেমন মেয়ে মেয়ে ঘ্রাণ লিখনি থেকে ভেসে আসছিল।
দোকানদারের কাছে ওটার দাম জিজ্ঞেস করতেই বলল,
: এটার দাম দেয়া লাগবে না। আপনে কত বই-ই তো আমার থেকে কিনছেন। এটা ফ্রি আপনার জন্য।
বনশ্রীর বাসায় এসে ড্রয়িংরুমে সোফাতে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম। ভালো লাগছিল না। কিছু একটা পড়তে ইচ্ছে করছিল। হঠাৎ ডায়েরিটার কথা মনে হল। উঠে বেডরুম থেকে নিয়ে এলাম। আমার সুন্দরী বাবুকে নিয়ে আম্মা আর ঝুমু সময় কাটাচ্ছে। আব্বা পবিত্র কোরআনের তাফসির পড়ছেন। অন্য ভাইয়েরা বাসায় নেই। ডায়েরি খুলে পড়া শুরু করলাম। তবে এর আগে পাতাগুলো উদ্দেশ্যবিহীনভাবে উলটে গেলাম। ঘ্রাণ শুঁকে দেখলাম। পাতাগুলো থেকে বেশ অতীতের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। কেমন রুষ্ট, বিবর্ণ আর নস্টালজিক ধোঁয়াটে বিষণ্ণ সেই ঘ্রাণ।
সময়ের ঘ্রাণ!
প্রথম কয়েক পাতার পরে পেন্সিল দিয়ে বাকীটা ডায়েরি লিখে ভর্তি করা হয়েছে। তবে প্রথম কয়েক পাতার বলপয়েন্ট দিয়ে লিখা আর পেন্সিলে লিখা- সম্পুর্ণ আলাদা। ভিন্ন মানুষের লিখা।
আয়েশ করে পড়া শুরু করলাম...
... ... ...
আমি মিথিলা।
আমার বাবা খুব শখ করে আমার এই নামটি রেখেছিলেন।
আমার মায়ের সাথে এই নামটি নিয়ে অনেক বাদানুবাদ হয়েছিল, যা আমাকে তিনি বুঝতে শিখবার পরে বলেছিলেন। তিনি আমার জন্য এমন একটি নাম চেয়েছিলেন, যা খুবই কমন হবে না।
মিথিলা কি একটি আনকমন নাম?
তবে কমন হোক আর আনকমন ই হোক, আমার বাবার পছন্দের নাম এটি। তাই আমার ও পছন্দের।
বাবার সব কিছুই আমার ভী...ষ...ণ পছন্দের!
সকাল থেকেই আজ কেন জানি ভালো লাগছে না। গতকালও কলেজে যেতে পারি নাই। টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল। আম্মু অফিসে। রিয়া স্কুলে। রিয়া আমার একমাত্র ছোট বোন।এবার সেভেনে পড়ে। কুসুম রান্না-বান্না সেরে ওর ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছে। কুসুম আমাদের বাসায় কাজ করলেও ওর সেই ছেলেবেলা থেকেই আমাদের বাসায় বড় হয়েছে। দিনের বেলায় ওর বাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় থাকে। আর রাতে ওদের এক রুমের ভাড়া বাসায় চলে যায়। ওর জামাই টেম্পু চালায়। ওদের সংসার বেশ ভালোই চলছে।
কলিং বেলের আওয়াজে আমার চিন্তার রেশ কেটে গেলো। বেশ কয়েকবার বেজে থেমে গেলো। কুসুমটা যে কালার কালা, হয়তো শুনতেই পায় নাই। আমাকেই উঠতে হল। দরোজার স্পাইহোলে চোখ লাগিয়ে দেখলাম কে এসেছে। আম্মু অপরিচিত কাউকে দেখে দরোজা খুলতে নিষেধ করেছেন। তারপরও খুললাম।
একজন ৩০/৩৫ বছর বয়সের যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকাতেই বলল,
: কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এসেছি ম্যাম। একটা পার্সেল আছে আপনার নামে।
: আমার নামে?
: হ্যা, মিথিলা কি আপনি?
: হ্যা, দেখি কে পাঠিয়েছে?
ডেলিভারি ম্যানের কাছ থেকে পার্সেলটি নিয়ে সেখানে উপরে আমার নাম লিখা দেখলাম। প্রেরকের যায়গায় আমার মেজ চাচার নাম।
এবারে সব পরিষ্কার হল। দাদু গতকাল ফোন করে বলেছিলেন বাবার কিছু জিনিস আছে, সেগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছেন। রিসিভিং সাইন করে দিতেই ডেলিভারি ম্যান চলে গেলো। দরোজা বন্ধ করে পার্সেলটি হাতে আমি আমার রুমে ঢুকে গেলাম। ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। দাদু এর ভিতরে কি পাঠাতে পারেন।
পার্সেলটা খুলতেই একটা সাধারন ডায়েরি বের হল। প্রথম চার পাঁচটা পাতা খালি।
এরপরের পাতাগুলো উল্টাতেই চমকে উঠলাম।
পেন্সিল দিয়ে লিখা... চোখের কোণ কখন যে ভিজে উঠল বুঝতেই পারলাম না।
এ যে আমার বাবার হাতের লিখা!
আমার বহু দিনের চেনা সেই অক্ষরগুলো! সেই নার্সারী থেকে স্কুল জীবনের প্রতিটি বই খাতায় তার হাতের লিখা ছাড়া আমার চলতোই না।
সুন্দর হস্তাক্ষর। আমার দেখা পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর হাতের লিখা।
অঝোর ধারায় গাল বেয়ে আমার বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে এতদিনের কষ্ট। জমাট বেঁধে থাকা নীল কষ্টগুলো বরফ হয়ে আমার আত্মাকে শীতল করে দিচ্ছে।
বাবা মারা গেছেন আজ ছয় বছর হল। ডায়েরিটা পেয়ে, বাবার সেই চিরচেনা হাতের লিখা যেন তার হাত হয়ে আমার সারা শরীরে স্নেহের পরশ বুলিয়ে গেলো। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম না। অনেকদিন পর কাঁদছি... আরো একটু কাঁদতে থাকি... বাবার স্মৃতি আজ একটু অন্যভাবে অনুভবের সোপানগুলোতে নাড়া দিয়ে যেতে চাচ্ছে যখন যাক না। একে রুদ্ধ করে কি লাভ?
পুরো ডায়েরিটাই বাবা পেন্সিল দিয়ে লিখে গেছেন। প্রথম লাইনটাই 'মিথিলা বাবু'!
বাসায় আমাকে বাবা সবসময় এই নামেই ডাকতেন। এ এমন একটা ডাক যা আমার পুরো সত্তায় মিশে আছে। এখনো আমার কানে ভাসে।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবা, আম্মু, রিয়া ও আমাকে নিয়ে আমাদের পরিবারটি অন্যান্য পরিবারের মত হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার মিশেলে জড়ানো ছিল। হঠাৎ এক ঝড় এসে সব আনন্দ উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বাবা কোনো অসুখ বিসুখ ছাড়াই চলে গেলেন।
অফিস থেকে এসে নামাজ পরে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমাকে কাছে ডাকলেন-
মিথিলা বাবু!
আমি কাছে আসতেই আমাকে তার মাথায় হাত বোলাতে বললেন। আমি আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বোলাতে থাকলাম। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। এই ঘুম যে চিরদিনের ঘুম, তা বুঝতে পারি নাই। এভাবে ঘুমের ভিতরই বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। এশার নামাজের জন্য আম্মু ডাকতে গেলেন। তখনই...
ডায়েরিটা ফোর বি পেন্সিল দিয়ে লিখা। বাবা এই পেন্সিল দিয়ে লিখতে খুব ভালোবাসতেন। আমি যখন খুব ছোট, তখনও আমাকে তিনি এই ফোর বি পেন্সিল এনে দিতেন।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বাবা পুরো ডায়েরিটা লিখে গেছেন। তার নিজের ভাষায় তিনি লিখে গেছেন। বড্ড সাবলীল সেই লিখনি। তার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার অনেক অজানা কথা তিনি আমাকে জানিয়েছেন। আমি ধীরে ধীরে সম্পুর্ণ ডায়েরির লিখা পড়ে শেষ করলাম।
অসাধারণ!
ডায়েরিতে বাবার অনুভূতিগুলো আমাকে কখনো কাঁদালো, কখনো হাসলাম, আবার বাবার নিজের বিরুপ সময়ের অসহায়ত্বে অনেক কষ্ট পেলাম। আমার মনে হল, বাবা এই লিখা শুধুমাত্র আমাদের জন্য লিখে গেলেও এটাকে বই আকারে ছাপানো দরকার। এ দেশের সমাজ, রাজনীতির কিছু ঐতিহাসিক মুহুর্ত তার জবানীতে উঠে এসেছে।
ডায়েরির প্রথম খালি পাতাগুলোতে আমি আমার নিজের জবানিতে এই পর্যন্ত লিখলাম। এটাকে বাবার বইয়ের মুখবন্ধও বলা যেতে পারে।
বাবার লিখার মুখবন্ধ তার প্রিয় মিথিলা বাবুর দ্বারা হল, নিশ্চয়ই তিনি ঐ জগতে বসে অনেক খুশী হবেন।
বাবা! তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।
তোমার এই বাবু তোমাকে সবসময়ের মত এখনো ভালোবাসে... তোমার কথা মনে করে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১২২২ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমিও অপেক্ষায় রইলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
নিজের প্রয়োজনে না হলেও অন্ততঃ কাছের কিছু মানুষদের জন্যে হলেও মুখোশের আড়ালে ভাল থাকার-সুখে থাকার মিছে আয়োজন করে যেতে হয়!
সাথে চলতে না পারলেও প্রতি টা পর্বে আপনাদের পিছু থাকার পাক্কা নিয়ত আমার!
ভালো থাকার কামনা.......!!!
আপনার জন্যও রইলো অনেক অনেক শুভকামনা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সাথে থাকবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমার বাবা এখনো মাশা আল্লাহ জীবিত আছেন। এটা নিছকই একটি লিখা। এই গল্পের মেয়েটির বাবা মারা গেছেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করছি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন